বাড়িটা গেটটার সমানে এসে আমরা দুজনেই কিছু সময় অপেক্ষা করলাম । ভেতরে ঢুকবো কিনা বুঝতে পারছি না । রেস্ট হাউঝ থেকে অবশ্য ঠিক করেই এসেছিলাম যে আজকে এই বাসাতে আমরা ঢুকবোই । এখানে যে থাকে সে নিশ্চয়ই আমাদের কে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতে পারবে না । টুকটাক কথা বলে জানার চেষ্টা করবো আসলে এই বাড়িটা সম্পর্কে যা প্রচলিত সেটা আসলে কত টুকু সত্যি । আমার অবশ্য খুব একটা ইচ্ছে নেই । মানুষ জনের সাথে আমার কথা বার্তা বলতে খুব একটা ইচ্ছে করে না । কিন্তু তৃষার যদি একবার কোন কিছু মাথায় ঢুকে যায় তাহলে সেটা কোন ভাবেই মাথা থেকে বের করতে পারে না । আর একবার যদি ঠিক করে ফেলে যে সে কাজটা করবে তাহলে সেই কাজটা সে করবেই ।
আমাদের বিয়ের পরে আমরা অনেক জায়গাতে ঘুরতে গিয়েছি কিন্তু সিলেটে এসেছি এই প্রথম । প্রথমদিন এসেই আমরা পুরোচা বাগানটা ঘুরে দেখেছি । তার পরদিনই এই বাসার খোজ পাই । বাসাটা বেশ পুরাতন । তৃষাদের চা বাগানের সীমানার একেবারে শেষ মাথায় একটা ছোট টিলার মত আছে । সেটার পরে কিছু গাছগাছালি । তার ভেতরে দিয়ে একটা রাস্তা এগিয়ে গেছে । সেই রাস্তার শেষ মাথায় এই বাড়িটা । বাড়িটা দুর থেকে দেখলে একটু ভুতুরেই মনে হয় । সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল বলে আমরা ভেতরে ঢুকি নি । রেস্টহাউজের কেয়ারটেকারের কাছে এই বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে চোখ বড় বড় করে বলল
-ভাইজান ঐ বাড়ির দিকে যাবেন না ।
তৃষা তখন বারান্দায় বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলো । কেয়ারটেকারের কন্ঠ শুনেই ফিরে তাকালো । তারপর বলল
-কেন ?
-ঐ বাসাতে কেউ যায় না । সবাই এড়ায়া চলে । ঐ বাসাতে এক সাহেব থাকে । আগে শহরে থাকতো । তারপর একদিন এখানে এসে থাকা শুরু করে । কারো সাথে মিশে না । সে আর তার বউ থাকে । তবে অনেকে মনে করে তার বউ নাকি মানুষ না । মাঝে মাঝে রাতে ঐ বাড়ি থেকে অদ্ভুদ আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় ।
তৃষার চোখ দেখেই আমি বুঝে গেলাম যে ব্যাপারটা নিয়ে সে আগ্রহী হয়ে উঠেছে । তার মানে হচ্ছে আমাদের আগামীকাল ঐ বাসাতে যওয়াই লাগবে ! তাই আজকে আবার এখানে এসে হাজির হয়েছি ।
আমি তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল
-এখানে ঢুকতে হবেই ? না ঢুকলে হয় না ?
তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আহ আমার বীর পুরুষ স্বামী । তুমি না আমাকে বলতা যে কোন কিছুতেই তুমি ভয় পাও না !
আমি বললাম
-এখানে ভয়ের কি দেখলা ? একটা অপরিচিত মানুষের বাসায় ঢোকাটা কেমন লাগে !
-যেমনই লাগুল । আমরা হাটতে এসেছে । এখন খানিকটা ক্লান্ত । আর একটু পানিও খাওয়া দরকার ।
আমি তৃষাকে খুব ভাল করে চিনি । তৃষা কখনও বাইরের জিনিস খায় না । এমন কি বাইরের মানুষের হাতে পানিও খায় না । এই অভ্যাস ওর অনেক আগে থেকে । আমি বললাম
-তুমি কত বাইরের পানি খাও !
-আমি খাবো কে বলল ! তুমি খাবে ! তোমার পানির পিপাসা পেয়েছে !
বুঝলাম আর তর্ক করে লাভ নেই, আমাদের ভেতরে ঢুকতেই হবে । আর দেরি করলাম না । বাড়ির গেটটার খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম । চারিদিকে একেবারে নির্জন । যদিও এই চা বাগানের পুরো এলাকাটাই নির্জন তবুও এখানে এসে আমি আসল নির্জনতা অনুভব করতে পারছি । কয়েক কদম এগিয়েছি তখনই একটা মৃদু গর্জনের আওয়াজ শুনতে পেলাম । তৃষার দিকে তাকিয়ে দেখি এসে দাড়িয়ে গেছে । তার মানে সেও গর্জনটা শুনতে পেয়েছে ।
আমি বলল
-শুনতে পাচ্ছো ?
-হুম ! কোন পশু কে যেন আটকে রাখা হয়েছে । শিকল দিয়ে !
আমি আরেকটু মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম । আসলেই তাই । পশুর গলার আওয়াজের সাথে একটা শিকলের নড়াচড়ার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে । আরও কয়েক কদম এগোতেই বাড়ির দরজাটা সটান করে খুলে গেল । আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম বটে তবে সামলে নিতে কষ্ট হল না । দরজা দিয়ে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরা নিতান্তই ভদ্রলোক গোছের একজন মানুষ বের হয়ে এসেছে । তার চোখে খানিকটা কৌতুহল । সম্ভবত তার বাসায় খুব একটা মানুষজন আসে না ।
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই তৃষা এগিয়ে গিয়ে বলল
-আমরা আসলে সরি এভাবে আপনার বাসায় না বলে ঢুকে পড়ার জন্য । আসলে হাটতে হাটতে আমরা খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি ।
আমি তখনও লোকটাকে লক্ষ্য করে চলেছি । কেয়ার টেকার এই লোক সম্পর্কে আমাদের যে রকম ধারনা দিয়েছে সেরকম কিছুই মনে হল না । বরং নিতান্তই ভদ্রলোক মনে হচ্ছে । তৃষা তখনও কথা বলেই চলেছে । তৃষা বলল
-ওর একটু পানি খাওয়া দরকার । যদি এই বারান্দাতে আমরা বসে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিই আপনি কি খুব আপত্তি করবেন ? পাশের নীলমনি টি স্টেট টা দেখছেন না, ওটা আমার বাবার ।
এবার দেখলাম লোকটার চেহারাটা খানিকটা প্রসন্ন হল । তিনি আরেকটু এগিয়ে এসে বলল
-আপনি আহসান সাহেবের মেয়ে !
তৃষা বলল
-জি ! আপনি চিনেন আমার বাবাকে !
-হ্যা উনাকে আমি চিনি । আসুন, বারান্দায় কেন ভেরতেই আসুন !
তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো । হাসি দিয়েই বলার চেষ্টা করলো যে দেখলে এসব একেবারে ডাল ভাত ওর জন্য ।
বসার ঘরটা বেশ গোছানো । বেশ ছিমছাম । আমরা বসতে না বসতে ভদ্রলোক পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে হাজির হল । তৃষা নিজের পানি ঢেলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল । যদিও আমার পানি পিপাসা একদমই পায় নি । কিন্তু সেটা ভেবে লাভ নেই । আমি গ্লাসটা এগিয়ে নিলাম ।
ভদ্রলোক নিজেই টুকটাক কথা বলতে লাগলো । তার নাম অভিক আহমেদ । এখানে একটা চালের আড়ত আছে তার । সেখানে অবশ্য খুব একটা যান না । বাসাতেই থাকেন বেশির ভাগ সময়ে । তৃষা এক সময়ে বলল
-আপনার ওয়াশরুমটা একটু ব্যবহার করা যাবে ?
-হ্যা হ্যা অবশ্যই । এই দরজা দিয়ে ডান দিকে । সবুজ দরজা !
তৃষা আমার দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে উঠে গেল । আমি বুঝতে পারলাম এবার পুরো বাড়িটা খুজে দেখতে যাচ্ছে । আমার উপর এখন দায়িত্ব হচ্ছে এই ভদ্রলোককে এখানে আটকে রাখা । সে যেন কোন ভাবেই ভেতরে না যেতে পারে । আমি অভিক আহমেদের সাথে কথা বলতে লাগলাম । আমি ঘরের চারিদিকে তাকাচ্ছিলাম । সোফা সেটের ঠিক উল্টো দিকেই একটা বড় ছবির ফ্রেম বাঁধানো । সেখানে অফিক আহমেদের সাথে এক সুদর্শনা মেয়েকে দেখা যাচছে । নিশ্চয়ই তার স্ত্রী হবে । আমাকে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভিক আহমেদ বলল
-আমাদের বিয়ের সময় তোলা ছবি ।
আমি একটু হাসলাম । বলল
-উনি এখন কোথায় ?
অভিক আহমেদ কিছু বলতে যাবে তখনই তৃষার চিৎকার শুনতে পেলাম । কোন কিছু দেখে সে যেন সত্যিই ভয় পেয়েছে । তারপরেই কোন হিংস্র পশুর আওয়াজ ! যেন শিকল থেকে নিকেজে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে । আমরা দুজনেই উঠে দাড়ালাম চট করেই ।
আমার আগে আগে ভদ্রলোক দৌড়াচ্ছেন । বাসাটা বাইরে থেকে যতখানি মনে হয়েছিলো ভেতরে আরও বড় । ভদ্রলোক অন্য কোন দিকে যাচ্ছে না । কোন কিছু খুজে দেখারও চেষ্টা করছে না । তার নামে সে খুব ভাল করেই জানে যে তৃষা কোথায় আছে ।
আমরা যখন নির্দিষ্ট স্থানে পৌছালাম দেখি তৃষা মেঝেতে পড়ে আছে । ওর মুখে ভয়ের ছাপ । একটা বড় বাক্স কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা । সেই কাপড়ের কিছুটা সরানো । আমি দ্রুত তৃষার কাছে এগিয়ে গেলাম । আভিক আহমেদ গেলেন খাঁচার কাছে ।
তৃষা খানিকটা ভীত কন্ঠে বলল
-কি ওটা ?
অভিক আহমেদ আমদের দিকে তাকিয়ে বললেন
-তো, আপনারা খোজ নিতে এখানে এসেছেন ?
আমি কিংবা তৃষা কেউ এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম না । অভিক আহমেদ বললেন
-আপনারা দয়া করে চলে যান !
তৃষা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে । সে বলল
-কি ওটা? আমাদেরকে বলুন ! আপনার স্ত্রী কোথায় ?
-এতো কিছু আপনাদের না জানলেও চলবে ? আপনারা দয়াকরে চলে যান !
-আমরা কোথাও যাবো না । যদি না বলেন তাহলে আমরা এখান থেকে সরাসরি থানাতে যাবো । তারপর সেখানে গিয়ে বলল আপনি আপনার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছেন । যখন পুলিশ আসবে তখন কিন্তু আর কিছু লুকানো থাকবে না ।
ভদ্রলোক হাল ছাড়ার মত ভাব করে বেশ কিছুটা সময় মাথা নিচু করে বসে রইলো । তারপর বলল
-আমি আমার স্ত্রীকে কিছুই করি নি । সে এখানেই আছে ।
তৃষা বলল
-কোথায় ? আমি পুরো বাসা ঘুরে দেখেছি । সে কোথায় নেই ।
অভিক আহমেদ এবার উঠে দাড়ালো । তারপর কালো কাল পর্দাটা টান দিয়ে নামিয়ে আনলো । আমি আর তৃষা দুজনেই অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে । ওটা কোন বক্স নয় বরং একটা বড় লোহার খাঁচা । সেখানে একটা প্রাণীকে দেখা যাচ্ছে । মানুষ ভাবতে কষ্ট হচ্ছে । তবে একটা সময়ে যে সে মানুষ ছিল সেটা কোন সন্দেহ নেই ।
পুরো শরীরে বেশ লোম জন্মেছে । চুপ গুলো বেশ বড় বড় । মুখের আকৃতিতে একটা মেয়ে মানুষের ছায়া এখনও বেশ স্পষ্ট, ড্রয়িং রুমে অভিক আহমেদের সাথে তার স্ত্রীর চেহারার সাথে আশ্চর্য মিল কিন্তু সেটা প্রাণীটার ভেতরে একটা বুনো ভাবটাকে ঢাকতে পারে নি । অভিক আহমেদ এবার বলল
-এ হচ্ছে আমার স্ত্রী । আইরিন !
আমি আর তৃষা কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে । একটা কথাও মুখ দিয়ে বের হল না । অভিক আহমেদ আবারও পর্দাটা দিয়ে খাঁচাটা ঢেকে দিল । তারপর বলল চলুন বসার ঘরে গিয়ে কথা বলি ।
আমাদের বসার ঘরে বসলাম । তৃষা আমার হাত তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছে । ভয়টা সম্ভবত তখনও কাটছে না । অভিক আহমেদ ফিরে এল আরেকটু পরে । তবে সে বসলো না । বাধাই করা ছবি সামনে দাড়িয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর তার গল্প শুরু করলো ।
একটা সময় ছিল যখন আইরিনকে কেউ জিজ্ঞেস করতো যে তার জীবনের লক্ষ্য কি তাহলে ও হয়তো বলতো যে তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট আর ক্যাফেতে গিয়ে নানান পদের আইটেম টেস্ট করা এবং সেই ফুডের ছবি তুলে ফুড ব্লগ গুলোতে রিভিউ দেওয়া । এটা ছাড়া তার জীবনের আর কোন লক্ষ্য নেই । ও খেতে খুব পছন্দ করতো !
সেটা হলেও না হয় একটা কথা ছিল । কিন্তু তার জীবনের আরেকটা লক্ষ্য হচ্ছে সেই খাবার গুলো তার স্বামীকে অর্থ্যাৎ আমাকেও জোর করে খাওয়ানোই । সে যেখানেই যাবে, আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবে। দুনিয়ার যত সব খাদ্য সে তো খাবেই সাথে সাথে আমাকেও টেস্ট করতে হবে । আমি মাঝে মাঝে আপত্তি তোলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোন লাভ হয় নি । আমাকে সাথে যেতেই হয়েছে । টাকা পয়সার কথা বাদ দিই, মাঝে মাঝে আমার পাকস্থলি সে সব সহ্য করতে পারে নি । কতবার যে ওয়াশরুমে দৌড়াতে হয়েছে সে হিসাব কেবল আমিই জানি !
তবুও কি আর করা ! ঘরের শান্তি বজায় রাখতে হলে মানুষকে কত কাজই না করতে হয় । আমিও করি !
তবে মাস খানেক ধরেই আমাকে আর এই ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছে না। আগে যেমন দুএক দিন পরপরই আইরিন একটা একটা রেস্টুরেন্টের খোজ নিয়ে আসতো আর আমাকে নিয়ে সেখানে হাজির হত । ছুটির দিন হলে তো কোন কথাই নেই । অফিসের দিন গুলোতেও অফিস শেষ করে রাতের খাবার বাইরে খেতে হত ওর সাথে । কিন্তু কদিন থেকে আইরিন আর এমন আবদার করছে না ।
একদিন কৌতুহলী হলে ব্যাপারটা জানতে চাইলাম । ও খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল যে এখন আর অন্য রেস্টুরেন্টের খাবার আর ভাল লাগে না । আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । বলে কি এই মেয়ে !
তারপর খোজ নিয়ে জানতে পারলাম যে সে বাইরে খাওয়া বন্ধ করে নি । তবে এখন থেকে কেবল একটা নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টের খাবারই কেবল খাচ্ছে । সেই খাবার ছাড়া নাকি অন্য কোন রেস্টুরেন্টের খাবার তার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না ।
আমাদের বাসা যে হাইজিং সেই হাউজিংয়ের একদম কাছের একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে মাস দুয়েক আগে । মাস খানেক আগে সেখানে খেতে গিয়েছিলাম । তারপর থেকে আইরিন কেবল সেখানেই যাচ্ছে । রেস্টুরেন্ট টার নাকি হোম ডেলিভারি দেওয়ার সিস্টেমও আছে । তাই মাঝে মাঝে কেবল ফোন করে দিলেও হয়ে যায় । বাসায় পৌছে যায় খাবার ! আমার জন্য সুসুংবাদ ! আমি অন্তত কিছুটা ঝামেলা মুক্ত হলাম ।
আমার বেশ পরিস্কার ভাবেই মনে আছে যেদিন আমরা ঐ রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। সব কিছু ভালই ছিল কিন্তু ওদের মাংসের একটা আইটেম আমার একদমই ভাল লাগেনি। আমি এক টুকরো মুখে নিয়ে আবার ফেলে দিয়েছিলাম। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব ছিল। কিন্তু আইরিনকে দেখলাম বেশ মজা করেই খাচ্ছিলো। আমি অবশ্য অন্য খাবার গুলো টেস্ট করছিলাম। আমার কাছে এমন আহামরি কিছু মনে হয় নি ।
যাইহোক সেটা তো মাস খানেক আগের কথা। সেদিনের পর আইরিন আসলে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য আমাকে বলে নি। আমিও অফিসের কাজের জন্য ব্যাপারটা প্রথমে খেয়াল করতে পারি নি। কিন্তু মাস খানেকের ভেতরেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম। নিজের কাছে একটু অবাক লাগলো৷ আইরিন তো এমন মেয়ে না৷ যত ভাল খারারই হোক আইরিন এক রেস্টুরেন্টের একই খাবার দুই একবারের বেশি খায় না, সেখানে একই রেস্টুরেন্টের একই খাবার ও প্রায় মাস খানেক ধরেই খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরও মাস খানেক যাওয়ার পরেও যখন দেখলাম ওর এই অভ্যাসটার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না তখন আমি খানিকটা চিন্তিত না হয়ে পারলাম না।
সব চেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে ও এখন তিন বেলায় কেবল ঐ রেস্টুরেন্টের খাবারই খায়। এখন আর বাইরেও বের হয় না । খাবার সময় হলেই সে ফোন করে দেয় । রেস্টুরেন্ট থেকে কেউ এসে খাবার দিয়ে যায় ! প্রতিদিনই সেই একই খাবার । সেই অদ্ভুদ স্বাধের মিট । অন্য কিছুই সে খেতে চায় না একদম। অন্য কিছু খায়ও না। আমি আবারও সেই মাংস আইটেম টেস্ট করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আগের মত অদ্ভুদ স্বাধের কারনে আমি গিলতে পারি নি। এই খাবার আইরিন কিভাবে খাচ্ছে সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।
সেই সাথে সাথে আইরিনের ভেতরে আমি আরেকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা শুরু করলাম । আইরিন আগে যেমন আদুরে আর হাসি খুশি মনভাবের মেয়ে ছিল দিন যতই যাচ্ছে ততই কেমন যেন নিশ্চুপ আর যাচ্ছে । আর কেমন যেন একটু হিংস্রও হয়ে উঠছে দিন দিন । খুব ছোট ঘটনা । সেদিন আমাদের বাসার কাজের মেয়েটা টেবিল পরিস্কার করতে গিয়ে একটা গ্লাস ফেলে দিল মেঝেতে ।
খুবই সাধারন ঘটনা । কিন্তু হঠাৎ দেখলাম আইরিন কোথা থেকে দৌড়ে এসে কাজের মেয়েটার চুলধরে ঠাস করে একটা চড় মেরে দিলো । কাজের মেয়েটি ব্যাথা পাবে কি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কেবল । আমি নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ।
আইরিন তো মোটেই এমন ছিল না ! হয়তো মেয়েটা আরও মারধর করতো আমি চট করে ওকে সরিয়ে নিয়ে এলাম । ওর চোখে সেদিন আমি যে রাগত ভাবটা দেখেছি সেটা আমি এর আগে কোন দিন দেখি নি । আমার কাছে ওকে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছিলো !
তারপরেই আসল ধাক্কাটা আসলো। একদিন আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসার সময় দেখলাম আমাদের বাসার পাশের ঐ রেস্টুরেন্টের সামনে অনেক গুলো পুলিশের গাড়ি৷ আর মানুষের ভীড়। আমি খানিকটা কৌতুহল নিয়েই সামনে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু তারপর যা জানতে পারলাম আমার চোখ কপালে উঠলো। পুলিশ এসে পুরো রেস্টুরেন্ট টা সীল করে দিল।
মাঝে মাঝেই ঢাকা শহরে এমন করে খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয় ভেজাল খাবারের জন্য। কিন্তু এই রেস্টুরেন্ট টা ভেজাল খাবারের জন্য বন্ধ হয় নি। এই রেস্টুরেন্টে মুরগি গরু ছাগলের মাংস রান্না করার সাথে সাথে মানুষের মাংসও ব্যবহার করা হত।
মানুষের মাংস ! আমি ভাবতেই পারলাম না কিছু সময় । আমি যদিও খাইনি ঐ মাংস তবে দুইবার আমি মুখে নিয়েছিলাম । আমার মাথার ভেতরে চক্কর দিয়ে উঠলো ।
একজন ডাক্তার এখানে খেতে এসেছিল। সেই মাংসটা টেস্ট করতেই প্রথমে সন্দেহ করে এবং আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে খাবার কিছু নিয়ে যায় সাথে করে ল্যাবে পরীক্ষা করার জন্য৷ল্যাবের পরীক্ষা রিপোর্ট নিয়ে পুলিশ নিয়ে হাজির হয়েছে। এখানে পুলিশ এসে হাতে না হাতে সেই প্রমান পেল পেয়েছে তারা। তারপর রেস্টুরেন্টের মালিক সহ সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে।
আমি খানিকটা হতভম্ব ভাব নিয়েই বাসায় ফিরে এলাম। বাসায় ফিরে দেখি আইরিন মুখ গম্ভীর হয়ে বসে আছে। আমার মনে হল রেস্টুরেন্টের খবর ও জানতে পেরেছে। তারপরই চুপ হয়ে আছে। আমি কি বলব ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওকে কি বলা উচিৎ সেটাও আমি জানি না। সে এতোদিন দিন রাত মানুষের মাংস খেয়ে এসেছে সেটা জানার পর ওর মনের অবস্থা কি হবে সেটা বুঝতে পারছি না।
রাতে আইরিন কিছু খেল না । অফিস থেকে ফেরার সময় কলিগদের সাথে নাস্তা করেছিলাম । তাই আমারও খুব একটা খাওয়ার দরকার পড়লো না । রাতে দুজন চুপচাপ শুয়ে রইলাম । কেউ কোন কথা বলছি না । কিন্তু আমি পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম যে আইরিন জেগে আছে । আমিও জেগে থাকার চেষ্টা করলাম কিছু সময় কিন্তু খুব বেশি সময় জেগে থাকতে পারলাম না ।
এভাবে তিনদিন কাটলো । আমি টকুটাক খাওয়া দাওয়া করছি কিন্তু আইরিন একেবারে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিল । বাড়ির কাজের মেয়েটা আমার কাছে বলল যে আইরিন নাকি কেমন যেন আচরন শুরু করেছে । তার আইরিনের সাথে থাকতে ভয় করছে ।
ঐদিন রাতে বেশ করে বোঝালাম ওকে । বললাম যে যা হওয়ার হয়ে গেছে । এই কথা আর কেউ জানবে না । এখন তো স্বাভাবিক হওয়া দরকার । আইরিন আমার দিকে অড্ভুদ চোখে তাকালো । কোন কথা বলল না । তারপর একটা সময় চুপ করে খাটে শুয়ে পড়লো । আমিও শুয়ে পড়লাম ।
ঘুমিয়ে গেলাম একটু পরেই । ঘুম ভাঙ্গলো একটু পরেই । একটু আগে মনে হলে কেউ যেন একটু গোঙ্গানীর মত আওয়াজ করছিল । সেই আওয়াজ শুনেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো । আমি উঠেই বাধরুম চেক করলাম । সেখানে আইরিন নেই ।
আমি শোবার ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম । মাঝের ঘরের আলো জ্বলছে । রান্না ঘর থেকে এখনও আওয়াজ আসছে । আইরিন কি রান্না ঘরে ? ওর হয়তো ক্ষুধা লেগেছে তাই সেখানে গিয়েছে কিছু খেতে । কিন্তু রান্না ঘরে গিয়ে আমি কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম ।
আমাদের কাজের মেয়েটা রান্না ঘরে মেঝেতে শুয়ে আছে । ওর শুয়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই মনে হচ্ছে মেয়েটা আর বেঁচে নেই, মেয়েটার গলা আর বুকের কাছে বড় একটা ক্ষত দেখতে পাচ্ছি ! বুকের মাংস কেউ যেন কেটে নিয়েছে। রান্না ঘরের মেঝেটা লাল রক্ত দিয়ে ভর্তি । সেই রক্তের ভেতরে দাড়িয়ে আইরিন কড়াইয়ে কি যেন রান্না করছে ।
আমার সাড়া পেয়ে আইরিন আমার দিকে ফিরে তাকালো । তারপর অপ্রতিস্থের মত হাসি দিল । বলল
-অভিক, খুব চমৎকার মাংস রান্না করছি । তুমি খাবা !
আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে তইলাম আইরিনের দিকে । ওর চোখের দিকে তাকিয়ে একটা তীব্র ভয়ের অনুভূতি হল । তারপর আর আমার কিছু মনে নেই ।
আমরা দুজনেই চুপ করে গল্প শুনছিলাম । তাকে চুপ থাকতে দেখে তৃষা বলল
-তারপর ?
-তারপর আর কি ?
-সারা রাত ওভাবেই থাকলাম। সকাল বেলা মাথা একটু ঠান্ডা হল । সব রক্ত পরিস্কার করলাম । কাজের মেয়েটার দেহের বেশ কিছুটা অংশ কেটে রেখে দিলাম ফ্রিজে । আইরিনের বাসায় ফোন দিয়ে আসতে বললাম । ওর বাবাকে সব খুলে বললাম । উনি বাকি ব্যবস্থা করলো ।
-ডাক্তার দেখান নি ।
-এমন কোন ডাক্তার নেই যে দেখাই নি । তারপর যখন সব স্থান থেকে ব্যর্থ হয়ে এলাম তখন এই এখানে এসে থাকা শুরু করলাম আইরিনদের হোম টাউন এখানেই । আইরিনের বাবা মা মাঝে মাঝে এখানে আসে । মেয়েকে দেখে যায় ।
আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো । কিন্তু সেটা বলবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না । অভিক আহমেদ যেন আমার মনের ভাব বুঝতে পারলো । তারপর বলল
-আপনারা হয়তো ভাবছেন এখন ওকে কি খাওয়াই ? তাই না ?
আমি বললাম
-হ্যা ।
-এখনও সেই একই জিনিস দেই ।
তৃষা বলল
-কোথায় পান ?
-হাসপাতাল গুলোর সাথে কথা বলা আছে । তারাই ব্যবস্থা করে দেয় । বেওয়ারিশ লাশ পেতে খুব একটা কষ্ট হয় না ।
আমরা ঐ বাড়িতে বেশি সময় থাকলাম না । ঐ বাসা থেকে বের হয়ে হাটার সময় তৃষা একদম আমার শরীর ঘেষে হাটতে লাগলো । ওর মুখটা থমথমে । আমি ওর কাঁধে হাত দিয়ে হাটতে লাগাম । তৃষা বলল
-দেখেছো নিজের বউকে সে কত ভালবাসে !
-কেন আমি আমার বউকে ভালবাসি না ?
-না আমি সেটা বলছি না । এই পরিস্থিতিতেও তাকে ছেড়ে যায় নি ।
আমি তৃষাকে বললাম
-ভয় পেও না তুমি যদি কোন নরমাংস খেতে শুরু করো আমিও তোমাকে ছেড়ে যাবো না !
-তাই না ? তুমি চাও আমি ওমন হয়ে যাই । শুনো যদি আমি ঐরকম হই না তাহলে সবার আগে তোমার মাংশ খাবো বুঝেছো !
আমি হাসতে থাকি । তৃষার ভেতরের একটু আগের গুমট ভাবটা কেটে গিয়েছে মুহুর্তেই ।