পর্ব ০৪
মুহিব কক্সবাজার থেকে রাজশাহী ফিরেছে দিন দুয়েক হয়েছে। এর মাঝে একবারও বাড়িতে কথা বলা হয়নি। ঠিক সময় পায়নি নাকি সময় পেতে চায়নি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চায় না মুহিব৷ বাড়ি থেকে ফেরার এই সময়টায় মুহিবের যেন মনে হয় পৃথিবী থেকে মিলিয়ে শূন্য হয়ে যেতে পারলে ভীষণ ভালো হত।
হলের ছোট্ট বিছানাটায় শুয়ে শুয়ে কিসব যেন ভাবছিলো মুহিব। হঠাৎই উঠে বসে হাত বাড়িতে গিটারটা নিলো। একটু আনমনে টুংটাং করতে লাগলো।
মুহিব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকে মুহিবের গানের প্রতি ভীষণ ঝোক ছিলো। আর তার মা চাইতো ছেলে যেন গানকেই নিজের জীবনের ক্যারিয়ার করে নেয়৷ তবে ঘটনার আকস্মিকতায় মুহিব ক্যারিয়ার তো দূর, নিজেকেই ভুলতে বসেছিলো। লম্বা একটা সময় সে কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলতো না, কোথাও বের হত না। এমন সময়ে রাবির নাট্যকলায় পড়ার সুযোগ পায় সে। আর ভাইবা দিয়ে টিকেও যায়।
জীবন যেন মুহিবকে আরো একটি সুযোগ দিয়েছিলো। যেই সুযোগ সে হাতছাড়া করেনি। কক্সবাজারে নিজের সবটুকু চিহ্ন না মুছতে পারলেও যতটুকু পেরেছে মুছে দিয়ে রাজশাহীতে বাসা বেধেছে। সোহরাওয়ার্দী হলের তিন তলার এক বারান্দাওয়ালা রুমের এক অংশেই আপাতত তার সংসার।মুহিব দুজনের রুমে থাকে। তাই স্পেসটা মোটামুটি ভালোই পেয়েছে। আর ছেলে হলেও ছোটবেলা থেকেই মুহিব ভীষণ গোছানো স্বভাবের। এই স্বভাবটা সে পেয়েছে তার মায়ের কাছ থেকে। তার বাবা যেমন অগোছালো ছিলো, তার মা ঠিক ছিলো উলটো। একদম পরিপাটি চাই সবকিছু। মুহিবও ঠিক তেমন। তাই সরকারি হলের ওইটুকু জায়গাও সে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। বারান্দায় রেখেছে ছোট্ট ছোট্ট বাহারী ফুলগাছ আর ক্যাকটাস গাছ।
মুহিবের রুমে যে কেউ ঢুকে কিছুক্ষণের জন্য নান্দনিক এক জগতে হারিয়ে যেতে বাধ্য হবে।"এবারের প্রোগ্রামে বোধহয় তোকেই গান গাইতে হবে মুহিব.."
মুহিব নিজের আপন মনে গিটারে টুংটাং করছিলো। শাহিল কখন রুমে ঢুকেছে খেয়ালই করেনি। গানের কথা শুনে কিছুটা চমকেই উঠলো সে৷ ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত সে বড় কোনো প্রোগ্রামে সেভাবে গান গায়নি। সুযোগ পায়নি তা না, বলা ভালো সুযোগ চায়নি৷ খুব জোরের মুখে না পড়লে কখনোই সে গান গায় না। কিন্তু এবারের সিচুয়েশনটা একটু আলাদা।
এক নতুন মেয়েকে দিয়ে গান গাওয়ানো হবে, তার অপজিটে কারো গানেরই ভোকাল ঠিকঠাক মানাচ্ছে না। সবার ধারণা মুহিবের গলা একদম পার্ফেক্ট যাবে৷ তাই সবাই ধরেছে মুহিবকে রিহার্সাল এর জন্য।
" কেনো? সেই মেয়ের গানের সাথে কারো গান যাচ্ছেই না? "
" কোথায় আর। মেয়েটার গলা বুঝলি অদ্ভুত রকমের সুন্দর, এমন গলা খুব কম পাওয়া যায়।"
" তাই নাকি? "
মুহিব শাহিলের আবেগি ভরা মুখখানা দেখে ব্যাঙ্গ করলো খানিকটা।
" জুনিয়র দেখলেই তোর এমন লাগে না রে শাহিল? ভালো হবি না তুই। "
" ইশ মুহিব মজা করিস না ভাই। আমি এবার সত্যিই বলছি। এই মেয়েটার গানের গলা অসাধারণ। আমার ধারণা তোর সাথে কবিতাতেও ভীষণ যাবে ওর। কাল একবার চল না রিহার্সাল টাইমে। আর তো হাতে সময়ও নেই। এরপরই আবার ফাইনাল পারফরম্যান্স স্যারদের দেখাতে হবে।"
মুহিব কি যেন একটা ভাবলো। এরপর কিছুটা অনিচ্ছা আর কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেও শেষমেশ রিহার্সালে যেতে রাজী হলো।মুহিব রাজী হতেই শাহিল ফোন করে কাদের যেন জানিয়ে দিলো যে মুহিব কাল যাচ্ছে।
শাহিল আর মুহিব রুমমেট হলেও তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মুহিব স্বভাবতই সবার সাথে চুপচাপ গম্ভীর থাকলেও শাহিলের কাছে একদম খোলা মনের মানুষ। হাসি ঠাট্টা গান মজা দুষ্টুমি সব করে ওরা দুজনে মিলে৷ ওদের দুই বন্ধুর জগতটা দুজনেই ভীষণ সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রেখেছে। সেই প্রথম বর্ষের শেষ দিকে দুই বন্ধু কিভাবে যেন হল পেয়ে গেলো তাও আবার একই রুমে। সেই থেকে আজ অব্দি দুজনের মধ্যে বড় ধরনের কোনো সমস্যাই হয়নি। এর পেছনে বলা যায় শাহিলের ভূমিকাই বেশি। মুহিবের সম্পর্ক সবটুকু জানে শাহিল। তাই ওকে কিভাবে আগলে রাখতে হবে, কোন কথা ধরা যাবে আর কোনটা না, কখন মজা করা যাবে আর কখন চুপ থাকতে হবে সবটা নিজ থেকেই মেইনটেইন করে যায় শাহিল।
আর এই বন্ধুত্বের মর্যাদা মুহিবও সবসময় রক্ষা করে চলার চেষ্টা করে।"একলা একা প্রজাপতি "
__ মেহেরুন নেছা হিতৈষী( চলবে....)