পার্ট - ১০

599 23 0
                                    


ফারান কে আমি কখনো কান্না করতে দেখি নি। শুধু দেখেছিলাম ওর অগ্নিমূর্তি। কিন্তু এই মুহুর্তে ফারানের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়া আমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ানক দৃশ্য বলে মনে হল। ওর চোখে মুখে কোন অভিব্যাক্তি ছিল না। কিন্তু ওর চোখ থেকে টপ টপ করে পড়া পানি যেন কোন শ্রাবনের কান্না বলে মনে হল। ওই ভিডিও থেকে এখনো ফারানের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু তখন আমি ছিলাম না। কারন আমাকে মারোয়ার আম্মু একটা রুমে নিয়ে আটকে রেখেছিল। আর এই কথাগুলো আমার কাছে অজানা ছিল। ও সবার কাছে অনুনয় করছিল যেন একবার তাকে আমার সাথে দেখা করতে দেয়া হয়। ও ওর ফুপির কাছে দুনিয়ার সবকিছুর বিনিময়ে আমাকে ভিক্ষা চাইছিল। কিন্তু সবাই মিলে ওকে চেপে ধরে ইনজেকশন লাগিয়ে দেয়। কতক্ষণ মোহিনী মোহিনী করতে করতে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যায় ফারান। এরপর সবাই ওকে ধরাধরি করে বাইরে কোথাও নিয়ে যায়। 
তারপর ভিডিওটা অফ হয়ে যায়। ফারান আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ খুলল। তারপর সে বলল
...... মোহিনী!! 
আরেকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
...... তুমিই আমার মোহিনী। আমি বলেছিলাম না!! 
আমি কোন রকম মাথা নাড়িয়ে বললাম
....... আমি মোহিনী না।
এই কথায় ফারান আমাকে ধরাবস্থায় দেওয়ালের সাথে এত জোরে চেপে ধরল যে আমার মাথায় যে কাটা বাধা ছিল ওই টা ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল। চুল গুলো সব খুলে গেল। আমি মাথায় প্রচুন্ড ব্যাথা পেলাম। 
...... আমার লাগছে! আহ!! ছাড়ুন!!
...... যখন আমার লেগেছিল তখন তুমি কোথায় ছিলে হাঁ?? এই খানে লেগেছিলো আমার (বুকের দিকে ইশারা করে)। ঠিক এই খানে। এর চেয়ে হাজার কোটি গুন ব্যাথা হয়েছিল আমার। তুমি জান এই খানে আঘাত হলে কি রকম ব্যাথা লাগে?? জান না!! কিছুই জান না। অথচ আমি আগুন ছাড়াই জ্বলে পুড়ে মরছিলাম। আমি আর জ্বলতে চাইনা। আমার তোমাকে চাই। এই বার তোমাকে তুমিও আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবেনা। কখনোই না!!
আমি শুধু শুনছিলাম ওর কথা। এখন কি হবে?? কেন আমি এসেছিলাম এখানে?? কি করবো এখন আমি?? বুঝতে পারলাম না।। 
...... দেখো ভালো হবেনা বলছি। আমাকে যেতে দাও।। 
ফারান একটু করে হাসি দিল যেন আমি একটা জোকস বলছি। তারপর ধীরে ধীরে খুলে আসা চুল গুলো মুখ থেকে সরিয়ে দিতে লাগল। তারপর আমি খেয়াল করলাম ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু আমার চোখের দিকে না। তাহলে ও কি দেখছে?? আমার ভিতরে কিছু একটার বিস্ফোরণ ঘটল। কারন ও সোজাসুজি আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ঠোঁট কামরাচ্ছিলাম। টেনশনে পড়লে অটোমেটিকলি আমি ঠোঁট কামরায়। তাই আমি তাড়াতাড়ি ঠোঁট কামরানো বন্ধ করলাম। আমার ঠোঁট কামরানো বন্ধ করা দেখে ও হাসল। তারপর আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরল। এত শক্ত করে আমাকে ধরল যে আমি ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমি ঠিকমত আওয়াজ টাও বের করতে পারছিলাম না। সবাই বাইরে নিশ্চয় আমাকে খুজছে। মারোয়ার ঘুমের সময়। শোওয়ার সময় আমাকে না পেলে কান্নাকাটি শুরু করবে। অনেক কষ্টে তাই বললাম
...... কি করছেন আপনি?? আমাকে ছেড়ে দেন। মারোয়া আমার জন্য অপেক্ষা করছে।।
ফারান কোন জবাব দিলনা। শুধু পিঠের মধ্যে হাত বুলাতে শুরু করেছিল। আর আমি নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিলাম। ওকে সরানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না। তারপর আমার ঘাড়ে কিছু একটার বার বার স্পর্শ পেলাম। সর্বনাশ!!! ফারান আমাকে চুমু দিচ্ছে!! এবার আমি ফারান কে ধাক্কা দিচ্ছিলাম। কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়াতে পারছিলাম না।
..... কি করছেন আপনি?? ছাড়ুন আমাকে!! ছাড়ুন বলছি!! 
আমি শুধুই বলছিলাম। আর ফারান আমার একটা কথাও শুনছিল না।
এবার এই ঘাড় ছেড়ে আমার বাম ঘাড় ধরল। ঘাড় থেকে চুমু দিতে দিতে সে আমার গালে মুখে চুমু দিচ্ছিল। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। ওকে থামাতে হবে। আমি ওকে দোহাই দিলাম।
...... দোহাই লাগে!! আমি বিবাহিত। আমি অন্যর স্ত্রী!! এটা গুনাহ।। আমাকে ছেড়ে দিন। আমার স্বামী আছে!!
এই কথায় মনে হল কাজ হয়েছে। হাত দিয়ে নিজের মুখটা মুছল। তারপর দুহাতে আমার মুখ টা ধরে আমার দিকে তাকাল। বলল
........ ভুলেও আমার প্রেম কে কখনো গুনাহ বলবেনা। এটা পবিত্র। আগামী তিন দিনের ভিতর তুমি আমার স্ত্রী হবে!! তখন তো কোন বাধা থাকবেনা!! কেউ থাকবেনা আমাদের মাঝে।। 
....... কখনোই না। আমি আপনাকে বিয়ে করবোনা!! জান গেলেও না।
আমার এই কথায় ফারান প্রচুন্ড রেগে গেল। সে বলল
...... কি বললা তুমি!! আরেক বার বলো!!! 
আমি তাড়াতাড়ি বললাম
..... হ্যাঁ ঠিক আছে।। আমি আপনাকে বিয়ে করবো। কিন্তু তার আগেতো মামুন কে ডিভোর্স দিতে হবে। তা না হলে বিয়ে হবেনা।।
....... তোমাকে পেতে আমার বিয়ের দরকার নাই। বিয়ে ছাড়াই আমি তোমাকে পুরো অধিকার করতে পারি।। কারন তুমি আমার মোহিনী!!!
দাঁত কিড়মিড় করে ফারান বলল। আমি বললাম
..... ঠিক আছে ঠিক আছে।। তবে আগে বিয়ে করতে হবে।। না হলে কিছু হবে না।।
....... শুধু মাত্র তোমার জন্য!!
...... এখন যেতে দিন। আমার খিদা লেগেছে।। আমি কিছু খাই নি।
...... হুম
ফারান আমাকে ছেড়ে দিল। আমি পিছন ফিরে দরজার নব ঘুরাব তখন সে আবার দরজা চেপে ধরল। কি হল আবার?? মনে মনে ভাবলাম। তবে মুখে হাসি ফুটিয়ে ওর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম কি হল। ও কিছু বলল না। শুধু মাত্র আমার কপালে একটা চুমু খেল। তারপর দরজা ছেড়ে দিল। আমি দরজা খুলে স্বাভাবিক ভাবে হাটতে লাগলাম। কারন ফারান পিছন থেকে সব নজর রাখছিল। এরপর ফারান চোখের আড়াল হতেই একটা দৌড় দিলাম। এক দৌড়েই রুমে এসে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ করেই সেখানে হেলান দিয়ে বসে গেলাম। তারপর আমি কাদঁতে শুরু করলাম। কতক্ষণ কান্না করছিলাম জানা নেই। কেউ একজন আমার মাথায় হাত রাখল। আমি মাথা তুললাম। এটা মামুন। ও মাত্র বাথরুম থেকে গোসল করে বেরিয়ে এসেছে। আমি কোন কিছু চিন্তা ভাবনা করলাম না। ঝাপিয়ে পড়লাম ওর বুকে। জড়িয়ে ধরলাম ওকে শক্ত করে। মামুন ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর আমাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল
...... কি হয়ছে?? কাদঁতেছো কেন?? কেউ কিছু বলছে??
আমি মাথা তুললাম। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
...... ও ও ও ফা ফারান সওওব জাজানে!!
...... কি জানে??
...... ও ও ও বলছে আমাকে নিয়ে যাবে তিন দিনের মধ্যে।
এই কথায় চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। আমি ওকে বললাম
...... আমি কোথাও যাবো না। কিছু একটা করেন।
এই বলে আমি আবার জড়িয়ে ধরলাম মামুন কে।।
মামুন চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। কিছু বলল না। শুধু মাত্র মাথায় হাত বুলাতে লাগল। এরপর আমি মাথা তুলে ওর দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে বললাম
...... আমাকে আজকে কাছে টেনে নিবা??
.
এই কথায় আমার নিজেরই অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় আরেক বার চেষ্টা করে দেখি। হতে পারে এর পর ফারান আমাকে ছেড়ে চলে যেতেও পারে।কিন্তু মামুন বলল
....... কিন্তু """""""
........ কোন কিন্তু না!!
....... কিন্তু তোমাকে শুনতে হবে!!
..... আমি শুনতে চাই না।
..... আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি!!
..... সিয়া! আমি জানি। কিন্তু তারপরও!! আমি চলে যাব। দেওয়াল হয়ে থাকবোনা।
...... রেনুমা!! 
মামুন মনে হয় আমার মনের কথা বুঝলো। সে আর প্রশ্ন করল না। আমাকে কোলে তুলে নিল। তারপর বিছানায় শুয়ে দিল। এরপর ধীরে ধীরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি শক্ত করে মামুন কে ধরে রাখলাম। মামুন ও আমার পাশে বসল তারপর আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
হঠাৎ বাইরে খুব চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ আসছিল। আমরা পাত্তা দিলাম না। কিন্তু কেউ দরজায় করাঘাত করে বলল
...... মামুন আগুন লেগেছে!! জলদি বেরিয়ে আয়!!
এই কথায় আমরা তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। মামুন আমাকে জলদি অাসতে বলে নিজে তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেল। আমিও বিছানা থেকে উঠে বাইরে বেরুলাম। সবাই আগুন আগুন বলে দৌড়াচ্ছে। আগুন কোথায় লেগেছে?? চাকর একটা কে জিজ্ঞেস করলাম। ও দোতালা একটা রুমের দিকে দেখিয়ে দিল। আমি ওই দিকে এগুলাম। দেখলাম বাড়ির সবাই ওই দিকে দৌড়াচ্ছে। ধোয়াই সব কিছু ঝাপসা হয়ে এসেছে। নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠছে। আগুন লাগা রুমটির সামনে গেলে দেখলাম সবাই ওখানে উপস্থিত। আগুন এতক্ষনে ওরা নিভিয়ে ফেলেছে। রুমের বেশির ভাগ জিনিস বের করে ফেলা হয়েছে। কারন ওগুলো সব আধ পোড়া। তারপরও কান্না কাটি থামছেনা কেন?? কিছু হইছে?? এমন সময় মামাকে ফোনে কথা বলতে শুনলাম। তিনি পুলিশ কে ফোন করে বলছিলেন যে রুমে ফাস লাগানো লাশ রয়েছে। কি হয়েছে না হয়েছে তারা বুঝতে পারছেনা। আমার বুকটা ধক করে উঠল। তাড়াতাড়ি সবাইকে ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকলাম। ফ্যানের সাথে একটা আধপোড়া ঝোলানো লাশ। এটা দেখে আমার গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো। তারপরও মুখ চেপে দেখতে চাইলাম। আমি দেখলাম ফারানের মায়ের লাশ ঝুলানো অবস্থায়!! অমনি আমার পিঠের শিড়দাড়া বেয়ে একটা শিহরন বয়ে গেল।
.
(চলবে)

 মোহিনী_২ ♥প্রেমান্ধ♥Where stories live. Discover now